Wednesday 23 May 2018

হিমালয়ের কোলে এবার (2006) ভাগ 2

বাপরে ! কত ভিড় ; শুধু মাথা আর মাথা আর এই জনসমুদ্রের মাঝখানে আমরা কজন রিতিমত কয়েক ফোঁটা জল কণা II এসবের মধ্যে দিয়ে সাপের মতো পথে খুবই ধীর গতিতে লাইন এগিয়ে ছোলেছে মূল ফাটকের দিকে II দেখতে দেখতে ঘণ্টা দুই পেড়িয়ে গেলো ; আর যেন তর সইছে না এবার তবু ধৈর্য ধরে দাড়ীয়ে রয়েছি প্রধানত তিনটি কারণে – 
১। মা এর বকুনির ভয় ।। 
২। পরিবেশটাই এমনই যে কিছু মনে হচ্ছে না ।। 
৩। একটা পুরনো কথার প্রভাব , কষ্ট করলে নাকি কেষ্ট পাওয়া যায় ( যদিও কেষ্ট আজ কিছু দুরে দাড়িয়ে আমার থেকে )।।
এরই মধ্যে একটি এমণ খবর আমার উৎসাহ কে আরও দ্বিগুণ করে তুললো ; মন্দিরে আজ পূজো দিতে এসেছেন অভিনেত্রী হেমা মালিনী ।। তিনি মন্দির থেকে বেড়োলে তারপর লাইন আবার চলতে শুরু করবে ।। 
নিকুচি করেছে লাইনের , আজ হেমা দিদির সাথে ছবি না তুলে ছাড়ছি না – এমনই সাত পাঁচ ভেবে চলেছি যখন ; ঠিক তখনি জনতার প্রবল উৎসাহ ভরা শব্দ আর চিৎকার জানান দিয়ে গেলো তিনি আসছেন ; তাও এপথেই ।। ব্যাস ! এক লাফ দিয়ে ; সবাইকে ঠেলে সরিয়ে সোজা মন্দিরের দালানে গিয়ে হাজির হলাম ; শুধু তাই নয় তার পিছন পিছন সোজা দৌড় মেরেছি তখন ।। ভাগ্যিস সিকিউরিটি আটকে দিল তাই ; নাহলে একটা ছবির নেশায় জুতো পরেই মন্দিরে দালানে উঠে পরেছিলাম আজ ।। সত্যি কতটা পাগল আমি ।। 
যাই হোক সোনার দরজা দুটি খুলে দেওয়া হল এবার সাধারনের জন্য ।। ওরা তো অসাধারন ; তাই ওদের জন্য বিশেষ ব্যাবস্থা করা হয় আর আমরা গরমে ঘেমে , বৃষ্টিতে ভিজে ছুটে চলি দর্শনে ।। 
মন্দির থেকে বেড়তে আরও আধ ঘণ্টা লেগে গেল ।। এতক্ষণে বাইরের তাপমাত্রা বেশ আনেকটাই কমে এসেছে আর এদিকে পেটে ইঁদুর দৌড় শুরু হয়ে গেছে ; সুতরাং ফিরে চল বাছাধন নিজের বাসায় ; আই মিন হোটেলে ।। বিকেলে আবার বেরোনো যাবে ।। ধুর ! এত জলদি ফিরে যাব বললেই হল , জাতটির নাম বাঙালি – ঘুরতে এসে কেনাকাটা না করলে রুটি হজম হবে না ।। হ্যাঁ , প্রচুর কেনাকাটি করার পর আজকের লাঞ্চ বাইরেই করে নেবো ঠিক করা হল – মেনু , তন্দুরি রটি আর ডাল মাখনি সাথে প্রচুর পেয়াজ ।। 
দুপুরের ঘুমতা ছোট হলে কি হবে বেশ ভালো হয়েছে কিন্তু ; যদিও তার রিএক্সন মোটেই ভালো হল না আজ ।। ঘুম যখন ভাংল তখন বিকেল পাঁচটা ; অনেক চেষ্টা করে লেপ আর আমার মধ্যে আজ যখন বিচ্ছেদ ঘটানো গেলো না তখন এক প্রকার বাধ্য হয়েই বাকিরা গেলো মানা দেখতে ।। মানা , সেটা কি ? বলছি , আগে বাকিদের বেরিয়ে যেতে দিন কারন বাবা তো রয়েছেই সঙ্গে , এ পথে বহুবার এসেছেন আগে ।। তারই মুখ থেকে শুনতে শুনতে চলো বেরিয়ে পড়ি শতপন্থ স্বারগারহিনি ভ্রমণে ।। কথিত আছে এই পথেই পঞ্চ পাণ্ডব স্বর্গ যাত্রা করেছিলো ।। এই সেই জায়গা বলা হয় যেখানে স্বর্গ যাওয়ার সিঁড়ি আছে ।। 
“ বাবা , এই স্বারগারহিনি যায় কোন রাস্তা দিয়ে ?”
বাবা হেসে বললো , “ আগে ওঠ , দু কাপ চা বলে আয় ... চা খেতে খেতে সব বলছি ।। “ এটুকু শোনা শেষ না হতেই দরজা খুলে হাক পারলাম , “ চায় , দো কাপ ... “ ।। শরিরে তখন কেমন যেন আমেজ খেলা করছে , যেন নিজেই যাব এবার ওই অচেনা পথে ।।

 

Tuesday 22 May 2018

হিমালয়ের কোলে এবার (2006) ভাগ 1

গল্পটার কোনো শুরু নেই কিন্তু , আগে ভাগেই বলে রাখলাম । বাড়িতে দিদিরা বেড়াতে এসেছে , তাদের মুখে শুনলাম তারা পাহাড়ে যাচ্ছে । আরে বাবা , পাহাড় মানে কেদার , বদ্রি এই সব , সোজা ভাষায় যাকে বলে হিমালয় ।। শুনেই লাফিয়ে উঠলাম ।। বাবা মাউন্টেনার ছিলেন । বাবার কাছে অনেক গল্প শুনেছি , তবে নিজে কোনোদিন যায়নি । বাবা অবশ্য এতো সহজে রাজি হয়ে যাবে বুঝতে পারি নি ।। মাস তিনেক আগেই রিজার্ভেশন করা হল ।। মোট আট জন ;আমি, বাবা আর মা ; বড়দি ও জামাইবাবু ; মেজ জেঠু ও দাদা ও অশোক দা ।। সময়টা শীতের আগেই , আই মিন সেপ্টেম্বর মাস । প্রথম গন্তব্য দিল্লি , ছোর দির বাড়ি ।। সেখান থেকে গাড়ি করে বেরিয়ে পরব আমরা পর্বত দর্শনে ।। 
দিন টা লক্ষ্মী পুজোর দিন । মায়ের নাম নিয়ে আসানসোল স্টেশন পৌছালাম । ট্রেন সাতটা ত্রিশ এর হাওড়া নিউ দিল্লি সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেস ।। কিন্তু গিয়ে শুনলাম ট্রেন হাওড়া ছাড়েনি তখনও । যা ! যাওয়া হবে তো ।। সালটা 2006 । ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষায় বসে কত লোক ।। অবশেষে রাত দশটায় ঘোষণা হলো ট্রেন হাওড়া ছেড়েছে ।। প্রাণে যেন প্রাণ এলো আমাদের ।। গাড়ি পৌছালো রাত সাড়ে বারোটা । সিট পেলাম , গাড়ি পেলাম ঠিকই কিন্তু ঝামেলা পিছু ছাড়ে না ।। ট্রেনের টিটি টিকিট এ একটা বড় খুত আবিষ্কার করেছেন ।। আর পায় কে ! একটা সিট অবশেষে ছাড়তে হলো আমাদের । এতক্ষনে একটু শান্ত হলো সব । ততক্ষনে বাইরে তাকিয়ে দেখি ধানবাদ পেরিয়ে গেছে গাড়ি , রাত বেশ গভীর ।। আর কি ঘুম হয় ! 
ভোর বেলায় ট্রেন পৌছালো শোন ব্রিজ , দেহরি অন সন । কি বিশাল সেতু ! আমি দেখছি আর ভাবছি , কত কিছুই দেখা বাকি এখনো আমার । ভোর পাঁচটায় মুঘলসরাই । এখনও তো অনেক বাকি ।। রাতের আনা খাবার খেয়েই চালিয়ে দিতে হবে ।
দাদার হাতে জাদু আছে । বিরিয়ানিটা দারুন করেছে কিন্তু । দু চামচের জায়গায় পুরো ছ চামচ মেরে দিলাম ।। এবার একটু হালকা ঘুম , যাকে বলে ভাত ঘুম আর তার পর সন্ধ্যের মধ্যে দিল্লি ।
দিল্লি পৌঁছাতে হয়ে গেলো রাত আটটা ।। পুরো সিক্স আওয়ার লেট ।। ঠিক হলো দিদির ওখানে রাত কাটিয়ে কাল সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পরা যাবে । বিকালে লক্ষ্য নৈনিতাল , সেখানেই দুদিন হল্ট ।। সন্ধ্যেবেলা যখন নৈনিতাল পৌছালাম সে এক অপরূপ দৃশ্য ।। আর যে ঘর বুক করা হল সেটি কাঠের কটেজ ।। যা লাগছে না মাইরি ।। বাইরে ঠান্ডা , ভিতরে লেপের তলায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তার ঠিক নেই ।।
পরেরদিন সকাল সকাল পৌঁছে গেছি ঝিলের ধারে ।। অসম্ভব সুন্দর ।। সেখানে রয়েছে নৈনি মাতার মন্দির ।। ইনার নাম অনুসারে তালটি মানে ঝিলটির নাম নৈনিতাল ।। সেখানে আবার বোটিং ও করা যায় , সুতরাং , আর কি চাই !! সকাল কাটলো দারুন ভাবে ।। মোহাব্বতে গাছের পাতার চাদরে বসে আড্ডা মেরে আর ঝিলে নৌকা বিহার করে ।। 
নৈনিতাল ছাড়া এখানে আছে ভিমতাল , সাততাল ও নুকুচিয়াতাল ।। এগুলো অবশ্য খুব কাছথেকে দেখি নি , তবে পরের দিন ফিরতি পথে ওই ভিউপয়েন্ট থেকে দেখেছিলাম ।। অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য ।। চারখাম্বা , ফালুট শৃঙ্গ দূর থেকে ধরা দিচ্ছিল চোখের সামনে ।। 
নৈনিতাল ছাড়লাম সকাল দশটা ।। এবার গন্তব্য কৌসানি ।।
পৌঁছাতে যথেষ্ট রাত হয়ে গেল ।। তা একটা হোটেল দেখে ঢুকে পড়লাম । সেরাত কাটিয়ে পরদিন তার পাশেই গান্ধীআশ্রমে রুম নিলাম ।। সেই পরিবেশ , বাগান আর তার থেকে বড় সেখানকার আদব কায়দা , সব মন ছুঁয়ে যায় ।। ডরমিটরি পেলেও কোন অসুবিধে ছিল না ।। সন্ধ্যার প্রার্থনা সভা , মনে হচ্ছিল পাহাড়ের বুকে এক সফল সন্ধ্যা ।। 
পরদিন সকালে ঠিক হল কাছাকাছি কোথাও ঘুরে আসা যাক , সাইড সিন তেমন সাথ না দিলেও , রাস্তা পরিষ্কার ছিল ।। পৌছালাম বইজনাথ ।। এর পাশ দিয়ে গোমতী নদী বয়ে গেছে ।। বলে নাকি এই খানেই শিব পার্বতীর বিয়ে হয়েছিল ।। সত্যি কি মিথ্যে জানি না , তবে এই নদীর জলে নানা রঙের মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখলাম ।। অপরূপ শোভা এই স্থানের ; যারা দেখেনি তাদের বলে বোঝাতে পারবো না ।। বিকেলে আবার ফিরে এলাম কৌসানি ।। ছেড়ে যেতে ইচ্ছে তো করছে না তোমায় , তবু কাল প্রস্থানের পথে এগোতে হবে আর এবার গাড়ি দৌড়াবে বদ্রি বিশালের পথে ।। 
সকাল সকাল উঠে পড়েছি , যেটুকু এনজয় করা যায় আর কি ।। চারদিক কুয়াশায় মোরা ।। মনে হচ্ছে , কেউ তাকে মেকআপ করে ছেড়ে দিয়েছে ।। ওদিকে স্করপিও ও রেডি ।। হর্ন মারছে মানে জয় বদ্রি বিশাল বলে বেরিয়ে পর ।। রাতে টার্গেট বদরিনাথ ।।
এই !! গান শুনতে শুনতে ভুলেই গেছিলাম বলতে কত পাহাড় , উঠলাম আর নামলাম ।। মন্দাকিনির হাত ধরে ছুটে চলেছে গাড়ি ।। কখনো তেল ভরছে , আবার দৌড় শুরু ।। রাস্তা , সে অপরূপ ।। পুরো প্রাকৃতিক , ডান দিকে পাহাড় আর পাথর আর নিচে মন্দাকিনির সাদা জলধারা ।। আর রাস্তা পুরো প্রাকৃতিক ।। পাথুরে রাস্তায় , ঝুলে থাকা পাথরের পাহাড় ; দেখলেও ভয় হয় ।। যখন এক একটা বাঁক ঘুরে ঘুরে ওপরের দিকে উঠছিলাম মনে হচ্ছিল সত্য অর্থে এটি হাই ওয়ে , ন্যাচারাল হাই ওয়ে ।। 
আর থাকা যাচ্ছিল না ।। গাড়িটাও এই পাহাড়ের গোড়ায় পাংকচার হতে হল ।। তবে না হলে এই বিউটি চোখে দেখা হত না ।। ভয় মিশ্রিত এক আনন্দ গ্রাস করেছে ।। মুখে বদ্রি বিশাল এর নাম আর বুকে পাগলামির নেশা ।। এ সুন্দরীর বুকে আজ মৃত্য এলেও শান্তি ।। 
ওই আবার হর্ন দিচ্ছে গাড়িটা ।। আর একটু দেরি করলে হত না !! এই প্রকৃতির খুবসুরত রূপ ছেড়ে যেতে মন চায় না ।। তবু চলাটাই জীবন ।। কিছু ফটো তুলে আবার গাড়িতে চেপে বসলাম ।। 
গানের সাথে সাথে গাড়িও চলছে দ্রুত গতিতে ।। সাপের মত একে বেঁকে উঠছে আবার নামছে ।। কখনো ডান দিকে নদী তো কখনো বাম দিকে ।। মাউন্টেন সিকনেস এ ভুগছি বেশ , তবু এ যাত্রার মজাটাই আলাদা ।। মুখে মুখে গান , বুকে ধ্বনিত জয় বদ্রি বিশাল ।। সাদা জলের ধারা খাদের নিচে আর স্করপিওর চাকা খাদের কিনারা ধরে দৌড়ে চলেছে ।। অবশেষে হাজির হলাম রুদ্রপ্রয়াগ ।। সেখানে দুপুরে খাবার খেয়ে আবার যাত্রা শুরু ।। 
এই রুদ্রপ্রয়াগে আলোকনন্দা ও মন্দাকিনি মিশেছে আর গঙ্গা হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ।। সুতরাং এবার আলোকনন্দা ধরে যাত্রা শুরু ।। 
জোশিমঠ পেরিয়ে যে রূপ দেখলাম তা সত্যি মনমুগ্ধকর ।। এখানে আছে আদি কেদার এর মন্দির ।। বলা হয় শীতে প্রচন্ড বরফের জন্য মন্দির বন্ধ থাকে এবং এই জোশিমঠএ তখন বদ্রি বিশালের পুজো হয় ।। রাত আট টা নাগাদ গাড়ি থামল , তবে এবার নারায়ণের ধাম ; বদ্রিবিশাল ।। 
রাত কাটলো , বাবার ডাকে ।। উঠেই তো আমি থ -- একি স্বপ্ন না সত্যি ।। সাদা পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে জানালার বাইরে সোনালী টুপি মাথায় জড়িয়ে ।। পর্বত মহারাজের জয় , প্রকৃতির জয় , বদ্রি বিশাল-এর জয় ।। জীবন স্বার্থক মনে হচ্ছে আজ ।।দেখেছেন তো , আপনাদের সাথে কথা বলতে বলতে ভুলেই গেছি যে সবাই মন্দিরে যাওয়ার জন্য প্রায় রেডি ; একমাত্র এই আমি ছাড়া II সুতরাং , আর নো কথা ; জল এখনো গরম আছে , স্নানে ঢুকলাম আমি II
“ এ কাঞ্চা , টোপী কিতনে কা দিয়া ?” 
“ সাহাব , পাঁচ কা এক II ” ---
কি বিশ্বাস হল না তো ! আমারও হচ্ছিল না II হোটেল থেকে বেড়িয়েই দেখি এক বাচ্চা ছেলে পাহাড়ি ভেড়ার লোম দিয়ে হাতে বানানো টুপি বেচছে II সস্তায় পেয়ে গোটা দশেক টুপি কিনে নিয়েই দৌড় দিলাম সবার পিছন পিছন ; এক কাঞ্চির দেখানো পথে মন্দিরের দিকে II

Sunday 12 November 2017

অশোক কি বৌদ্ধ হতে পেরেছিলেন ?

অশোক কি বৌদ্ধ হতে পেরেছিলেন ?

মৌর্য সাম্রাজ্য ভারতের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে , কারণ , এই সাম্রাজ্য নিজ ক্ষমতা বলে সামান্য মগধ এর সাম্রাজ্য থেকে প্রায় সমগ্র উত্তর ভারতের অধিপতি হয়ে বসে ।। তৎকালীন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার যে , মৌর্য্য বংশ যে পরিমান রাজ্য জয় করেছিল তা সত্য প্রশংসার যোগ্য ।। তবে রাজ্য বিস্তার ছাড়াও যে বিষয়টি এই সময়ের প্রধান আলোচ্য বিষয় তা হল ক্রমাগত পরিবর্তন হতে থাকা ধর্ম ।। বিভিন্ন রাজার শাসনকালে বিভিন্ন ধর্মের প্রাধান্য এ সময়ে দেখা গেছে ।। তবে যার ধর্মনীতি নিয়ে সবসময় আলোচনা চলে এসেছে তা হল অশোক ।। অশোকের বৌদ্ধ ধর্ম অবলম্বন করা ও চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোক এ পরিবর্তনের বিষয়টি চিরকাল আলোচনার বিষয় হয়ে ফুটে উঠেছে ।। 
অশোকের উত্তর কলিঙ্গ যুদ্ধ যুগ ও তারপর বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন বিষয়টি আজও গবেষণার বিষয় ।। আমি এখানে সে নিয়ে বিশেষ আলোকপাত করতে আসিনি , শুধু এটুকু আলোচনা করতে এসেছি যে অশোক কি সত্যি বৌদ্ধ হতে পেরেছিলেন ।। এর উত্তর পেতে আমাদের ফিরে যেতে হবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের শাসনকালে ।। 

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য : 

মৌর্য্য বংশের প্রতিষ্ঠা করেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য , 322 খ্রিস্ট পূর্বব্দে ।। তার রাজত্বে সাম্রাজ্য বিশাল বিস্তার লাভ করে এবং মৌর্য্য এক শক্তিশালী শক্তিরূপে ফুটে ওঠে ।। কিন্তু জীবনের শেষ দিকে তিনি জৈন ধর্ম গ্রহন করেন এবং রাজ্যপাট সমস্ত ত্যাগ করেন ।। শ্রবনবেলগোলায় যখন তাকে মৃত পাওয়া যায় ( 187 BC) তখন তার শরীরে কোন বস্ত্র পর্যন্ত ছিল না ।।

বিন্দুসার : 

চন্দ্রগুপ্ত এর পর সিংহাসনে বসেন বিন্দুসার ।। এ বিষয়ে কোন সংশয় নেই যে তিনি হিন্দু ছিলেন ।। বৌদ্ধ ও জৈন উভয় মতেই এ বিষয়টি উল্লেখ করা আছে ।। বৌদ্ধ মতে তিনি ব্রাহ্মণ্য ধর্মে দীক্ষিত ছিলেন ।। বৌদ্ধ গ্রন্থ সামন্ত্পাসাদিকা ও মহাবংশে বিন্দুসারকে ব্রাহ্মণাভট্ট নামে উল্লেখ করা হয়েছে ।। আর জৈনদের মতে তিনি জৈন ছিলেন না ।।

অশোক : 

বিন্দুসার পুত্র অশোক তৃতীয় মৌর্য্য সম্রাট ছিলেন ।। তার ধর্ম নিয়ে কিছু সংশয় আজও থাকলেও , বেশিরভাগ জায়গায় এটি পরিষ্কার যে 263 তে কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করেন , যদিও কোন কোন ইতিহাসবিদ তাকে জৈন বলেও চিহ্নিত করেছেন ।। তবে বেশির ভাগ প্রমান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে অশোক বৌদ্ধ ধর্মই গ্রহণ করেছিলেন এবং বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেছেন ।। তবে তার এই হঠাৎ পরিবর্তনে কিছু সংশয় থেকেই যায় ।। প্রশ্ন উঠতেই থাকে অশোক কি বৌদ্ধ হতে পেরেছিলেন ? আর এই বিষয়টি আমরা বিভিন্ন প্রমান ও প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আলোচনা করে দেখার চেষ্টা করব ।।
ব্রিটিশ শাসনকাল অবধি এই দেশ অশোক নিয়ে সেরাম গবেষণা করে নি ।। তবে প্রথম জন মার্শাল সাঁচি ও সার্নাথ নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং পরবর্তীতে আলেক্সান্ডার কানিংহাম ভারহুত , সাঁচি , সার্নাথ ও মহাবধি মন্দির এর খোঁজ করেন যা অশোক সম্বন্ধে যথেষ্ট জানতে সাহায্য করেছে ।। 
এবার বৌদ্ধ কিছু সূত্র সম্বন্ধে বলছি যা অশোকের জীবন ও রাজত্বকালের ওপর যথেষ্ট আলোকপাত করেছে ।। দ্বিতীয় শতাব্দীতে লেখা সংস্কৃত অশোকবদন , অশোকের জীবনী ও শাসনকাল সম্পর্কে বিস্তৃত ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকে ।। এ ছাড়াও পালি ভাষায় রচিত দীপবংশ ও মহাবংশ বই দুটিও অশোকের রাজত্বকালের ওপর যথেষ্ট আলোকপাত করেছিল ।। দুটি বই শ্রীলঙ্কা থেকে পাওয়া গেছে , যা প্রমান করে অশোকের রাজত্ব শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ।। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব ? অশোক তো কলিঙ্গ বিস্তারের পরে নিজের রাজ্য বিজয় পর্ব শেষ করে দিয়েছিলেন ও বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন ।। 
এ সবই আলোচনার বিষয় এবং এ বিষয়ে আলোকপাত করতেই আজ এই লেখা ।। 
অশোকের শাসনকালে মোট 33 টি শিলা লিপি আজ অবধি আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এখান থেকে স্পষ্ট বোঝা গেছে যে অশোক বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত ছিলেন এবং বৌদ্ধ ধর্মকে অনুসরণ করতেন ।। বর্তমান পাকিস্তান ও ভারত এর মধ্যে থেকে উদ্ধার হওয়া এই শিলালেখ বৌদ্ধ ধর্মের সাথে অশোকের সম্পর্কের প্রথম প্রমান হিসাবে আমরা গ্রহণ করেছি এবং এ প্রমান থেকে খুবই স্পষ্ট যে বৌদ্ধ রীতি মেনে অশোক সামাজিক কল্যানে রত হন , পশু হত্যা বন্ধের নির্দেশ দেন ।। 
এসব থেকে একটি কথা পরিষ্কার যে কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক সত্যি ধর্মাশোক হয়ে গিয়েছিলেন ।। অতীত জীবনে যে অশোকের ছবি আমরা দেখেছিলাম , অর্থাৎ যে অশোক নিজের 99 টি ভাইকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেছিলেন এবং ক্রুরতার সাথে রাজ্য বিজয় শুরু করেন , তা সত্যি কি একটি যুদ্ধের পড়েই বদলে গেল ? এত রক্তের পথে যে সম্রাট হেঁটে এলেন , তিনি হঠাৎ বদলে গেলেন কেন ? অশোকের 13 নম্বর শিলালেখ থেকেও পরিষ্কার ছিল যে তিনি বৌদ্ধ ধর্মই গ্রহণ করেছিলেন , কিন্তু কেন ? পিতামহের ধর্ম ছিল জৈন বা পিতার হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্মই কেন গ্রহণ করলেন ? এ সমস্ত প্রশ্ন ইতিহাসের মাধ্যমে আলোকপাত করাটাই আমাদের লক্ষ্য ।। বিশ্ব শান্তির এত বড় পথিকৃৎ অশোকের বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে ঘনিষ্ঠতার সত্যতা প্রমান সাপেক্ষে বিশ্লেষণ করে দেখাটাই আমার লক্ষ্য ।।
এবার কিছু উল্লেখযোগ্য বৌদ্ধ গ্রন্থ ও তার ভিত্তিতে অশোকের চরিত্রের ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করব ।। বৌদ্ধ দের অবদান অশোকের জীবনে হঠাৎ করে আসে নি একথা নিশ্চিন্তেই বলা সম্ভব , কারণ বৌদ্ধ আলোচনা থেকেই আমরা সর্বপ্রথম চণ্ডাশোক নামটি পেয়ে থাকি ।। বৌদ্ধ গ্রন্থ দীপবংশ ও মহাবংশে পরিষ্কার ভাবে উল্লিখিত আছে যে অশোক নিজের 99 টি ভাই কে হত্যা করে মগধের সিংহাসনে বসেন ।। অবশ্য ভিতাশোক বা তিশা কে কেন ছেড়ে দিয়েছিলেন সেটা আজও অজানা ।। তিনি শাস্তি প্রদানের জন্য ashoka's hell তৈরি করেছিলেন , যা সত্যি ভয়ানক ছিল ।। এই রূপ চরিত্রের মানুষ কলিঙ্গ বিজয়ের পর সম্পূর্ণ বদলে গেল এবং ধর্মাশোক হয়ে গেলেন , এও বৌদ্ধ প্রচারের ফলেই জানা গেছে ।। অশোকের 13 নম্বর শিলালেখ এ বিষয়ে আলোচনা করে গেছে ।।
এবারে আসা যাক অপর এক গ্রন্থের আলোচনা প্রসঙ্গে ।। অশোকের জীবন ও রাজত্বের ওপর লিখিত এই গ্রন্থটির নাম অশোকবদন ।। 303 এ ফাহিয়েন এটি অনুবাদ করেন ।। এই গ্রন্থে স্পষ্ট আকারে রাজা ও সংঘের সম্পর্ক বর্ণিত আছে , যা থেকে স্পষ্ট যে অশোক বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন এবং তিনি নিজের রাজক্ষমতার প্রয়োগ করে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার লাভ করেন ।। নিজের ছেলে মহেন্দ্র ও মেয়ে সংহমিত্রা কে শ্রীলঙ্কা , কামবডিয়া , সিলন , জাভা , ইন্দোনেশিয়া এবং বিভিন্ন দেশে পাঠান ।। দেশের নানা স্থানে বৌদ্ধ মঠ , স্তুপ নির্মাণ করেন ।। বিশ্বশান্তির এক অভূতপূর্ব যোজ্ঞ ভারতে শুরু হয় তার আমলের শেষ দিকে ।। 
চক্রবর্তী হতে আসা অশোক অবশেষে এক অদ্ভুত পরিবর্তন এর শিকার হন এবং এক অপূর্বদর্শিত রাজধর্ম ভারতে দেখা যেতে থাকে ।। এ সত্যি গর্বের বিষয় ছিল সমগ্র ভারত তথা বৌদ্ধ ধর্মের কাছে ।।
তবে সমকালীন যুগে উঠে আসা দুটি ধর্মের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মকে সমর্থনের ফলে , অশোক কে কাটঘরা থেকে নামানো সম্ভব নয় ।। এমন নয় যে তার পরিবারে অন্য ধর্মের ছোঁয়া লাগেনি ।। তার দাদু জৈন ধর্ম গ্রহন করেন , এবং জৈন রা বিশ্ব শান্তির কথাই বলে চলেছিলেন , তবু তার বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করাটা একেবারে বিশ্বাস করতে মন চায় না ।। হতে পারে , এটা তার ব্যক্তিগত মত ছিল , তবু প্রশ্ন থেকেই যায় অশোক কি সত্যি কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে বুদ্ধর আশ্রয় নিলেন ? শান্তির এই পথে অশোক কি বৌদ্ধ হতে পেরেছিলেন ? তথ্য প্রমাণ কি বলেন সে সবই আলোচনার অংশবিশেষ ।। সর্বোপরি একটি প্রশ্ন মনে বড়োই উঁকি দিতে থাকে , ক্রোধ , বদ মেজাজ ত্যাগ করে শান্তির এই দূত হয়ে ওঠা অশোকের কোন কূটনৈতিক পরিকল্পনা ছিল না তো ? 
আবার ফিরে আসি অশোকবদন এর প্রসঙ্গে ।। বইটিতে কিছু বিষয় সত্যি অবাক করে দেয় ।। সে গুলি একবার পর্যালোচনা করে দেখে নেওয়া যাক ---
১. আমরা সবাই জানি অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের পর বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করেন ।। কিন্তু অশোকের জীবনী ও রাজত্বকালের ওপর লেখা বৌদ্ধদের সবচেয়ে প্রধান গ্রন্থটিতে কোথাও উল্লেখ নেই যে অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের পড়েই বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করেছিল ।।

২. ওই গ্রন্থ অনুযায়ী বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের পরেও অশোক অহিংসা নীতি গ্রহণ করতে পারেনি ।। এ বিষয়ে একটি ঘটনাও উল্লেখ করা হয়েছে বইটিতে ।। পুন্ড্রবর্ধন নামে জনৈক জৈন শিল্পী একটি ছবি আঁকেন , যেখানে বুদ্ধ কে নতজানু হতে দেখা যায় নিরগ্রন্থ জ্ঞাতিপুত্রের সামনে ।। এতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা রেগে যায় ও অশোকের কাছে অভিযোগ করেন ।। এ কথা শুনে অশোক ক্রোধিত হয়ে পুন্ড্রবর্ধন কে গ্রেফতার করেন ও তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন ।। 
এই ঘটনার কিছু দিন পরে অপর একজন ওই একই ছবি আঁকেন ।। অশোক তাকে পরিবার সহ পুড়িয়ে মারার আদেশ দেন ।। এর থেকে পরিষ্কার অশোকের মধ্যে যে চন্ডাল রূপ বিরাজ করছিল অতীত থেকে তা বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের পরেও বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয় নি ।। সত্যি বলতে অশোক কোনদিনই বৌদ্ধ হতেই পারে নি ।। বৌদ্ধ বেসে অশোকের মনে এক কুটিল রাজনৈতিক চাল দেখা গেছে  , যা সত্যি বুঝে ওঠা বাকিদের পক্ষে কঠিন ছিল ।।
সমস্ত তথ্য প্রমাণ পেস করার পর দুটি প্রশ্ন মনে উঠে আসাটাই স্বাভাবিক ; 
১. অশোক রুপি কাক , তাহলে বৌদ্ধ রুপি ময়ূরের পেখম কেন ধারণ করল ? গিরগিটির মত তার এই রূপ পরিবর্তনের কারন কি ছিল ?
২. বৌদ্ধ কেন , জৈন কেন নয় ?
এর উত্তর খুঁজতে অশোকের অতীত টুকু একবার ঘেঁটে দেখতে হয় আমাদের ।। 
আগেই বলে এসেছি যে অশোকের পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য জৈন ধর্ম গ্রহন করেন , এবং জৈন ধর্মের নিয়মেই নিজের সমস্ত কিছু ত্যাগ করেছিলেন ।। অশোক কিন্তু ত্যাগ করতে রাজসিংহাসনে বসেন নি ।। তার পিতা বিন্দুসার কোনোদিন অশোককে সিংহাসন দিতে চান নি ।। তার ইচ্ছে ছিল তার বড় ছেলে রাজা হোক ।। অশোক নিজের ক্ষমতা বলে রাজসিংহাসন দখল করেন ।। তার স্বপ্ন ছিল তিনি মগধের এই সাম্রাজ্যের পতাকা পুরো ভারতে ছড়িয়ে দেবেন এবং তার জন্য তিনি হিংস্র নীতি গ্রহণ করেছিলেন ।। তাই স্বাভাবিক ভাবে তার সমস্ত প্রাপ্তি তিনি ত্যাগ করবেন এটা ভাবাও মূর্খতা ।। আর সেই জন্যই জৈন ধর্ম তিনি গ্রহণ করেন নি ।।
তবে , বৌদ্ধ ধর্ম এই পূর্ণ ত্যাগের কথা বলে না , তাই বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণে তার আপত্তি হয় নি ।। তবে ধর্ম গ্রহন করলেও নিজেকে পরিবর্তন বা নিজের প্রায়শ্চিত্ত এসব তার ইচ্ছে ছিল না ।।
কলিঙ্গ যুদ্ধের পর সমগ্র উত্তর ভারত তার অধীনে চলে এসেছিল , কিন্তু তৎকালীন যুগে বিন্দ পর্বত ভেদ করে দক্ষিণ ভারতে যুদ্ধ করতে যাওয়া অসম্ভব ছিল , তাই তিনি ধর্মের ঘোমটার আড়ালে লুকিয়ে সে সমস্ত রাজ্য গুলিতে প্রবেশ করেন ।। তারাও বিশ্ব শান্তির দূত হিসাবে অশোকের বস্বতা স্বীকার করে নেয় ।।
এভাবে , এক কূটনৈতিক পদ্ধতি অবলম্বন করে অশোক পুরো ভারত সহ বিভিন্ন দেশে রাজত্ব বিস্তার করেছিলেন ।। 
এ সম্পূর্ণ আলোচনা থেকে দুটি জিনিস পরিষ্কার :
১. চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকে সম্রাট অশোক কোনদিন উত্তীর্ণ হন নি ।। এই তথ্যটি সম্পূর্ণ ভুল ও মিথ্যা ।।
২. একান্ত ব্যক্তিগত কারণে তিনি বৌদ্ধ ধর্মকে ব্যবহার করে গিয়েছেন এবং নিজে একজন নামধারি বৌদ্ধ হিসাবে জীবন কাটিয়ে গিয়েছিলেন ।।
অবশেষে , একটি কথা অবশ্যই বলব ; ইতিহাস থেকে এতকাল প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে এই আলোচনা , তাই জ্ঞানী গুণী সকলের মতামত অবশ্যই কাম্য ।।